বাংলাদেশে চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত একশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে বেসরকারি একটা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। মাদক চোরাচালানী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এ অভিযান হঠাৎ করেই শুরু হয়নি।
এর পেছনে রয়েছে মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করার জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রবল ইচ্ছা, এমনটাই জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম।
তবে মাদক বিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহতের ঘটনা নিয়ে নানা সমালোচনা শুরু হয়েছে।
এই অভিযানের পটভূমি ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ. টি. ইমাম বিবিসি বাংলাকে ২৩ মে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, এ বছর অন্তত তিনটি বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা বলেছিলেন।
তার ধারাবাহিকতাতেই এ অভিযান চলছে। জানুয়ারি মাসে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার মধ্যে মাদককে “গুরুতর সমস্যা” হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তিনি বলেন, “এরপর পুলিশের দ্বিতীয় আরেকটি অনুষ্ঠানে এবং তৃতীয়বার গত মাসে সারদায় পুলিশ ট্রেনিং একাডেমিতে ভাষণেও তিনি মাদক সমস্যার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।”
গত ১১ই মে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে ভাষণ দেয়ার সময় শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের পাশাপাশি মাদক সমস্যা থেকে ছাত্র সমাজকে দূরে থাকার আহ্বান জানান।
মি. ইমাম বলছিলেন, “ঐ ভাষণেই তিনি জানান যে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তিনি ইতোমধ্যেই র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন।
গত ৩রা মে র্যাব সদর দফতরে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গিবাদের মতো সমস্যার মোকাবেলায় র্যাব যেমন সাফল্য দেখিয়েছে, তেমনি মাদক চোরাচালানী বা মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে র্যাব কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ঐ বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, মাদক তৈরি, বিক্রি, পরিবহন এবং সেবনের সাথে যারা জড়িত তাদের সবাই সমানভাবে দোষী বলে প্রধানমন্ত্রী অভিমত ব্যক্ত করেন।
মূলত এর পর থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর এই বিশেষ অভিযান শুরু হয়।
কতজন নিহত হয়েছে
বাংলাদেশে চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত একশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে বেসরকারি একটা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে।
যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষায় বন্দুকযুদ্ধে এখন পর্যন্ত কতজন নিহত হয়েছে তার কোন হিসেব নেই।
তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে আংশিক হিসেব পাওয়া যাচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার মে মাসের ১৫ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত হিসেব দিয়েছিল ৪৯ জন নিহত হয়েছে।
দেশজুড়ে চলা এই অভিযানে কুষ্টিয়া, নারায়নগঞ্জ, বরিশাল, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, ফেনী, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, টাঙ্গাইল, নরসিন্ধী, চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর, কুমিল্লা, ব্রাক্ষবাড়িয়া, ঠাকুরগাও, জামালপুর, রংপুর,গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, মাগুরা জেলার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব জেলায় এক থেকে একাধিক নিহতের ঘটনা রয়েছে।
সরকার কী বলছে?
প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনা অনুযায়ী, মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ-র্যাবের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
২২ শে মে সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।
“মাদক ব্যবসায়ীরা অনেক প্রভাবশালী। তাদের কাছে সবধরনের অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। তাই আমাদের নিরাপত্তাবাহিনী যখনই অভিযান চালাতে গেছে তাদের ওপর হামলা হয়েছে। সে কারণেই এই নিহতের ঘটনাগুলো ঘটেছে” বলেন তিনি।
এর আগে, মাদকবিরোধী প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে সারাদেশে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করে নিরাপত্তা বাহিনী, যার স্লোগান -”চলো যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে।”
র্যাব কী বলছে?
র্যাব বলছে এই অভিযান শুরু হয়েছে ৪ঠা মে থেকে।
র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান ২৭ শে মে বিবিসিকে বলেন, “যারা এ পর্যন্ত আটককৃত হয়েছে, যারা সশস্ত্র অবস্থায় নিহত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তো অসংখ্য অভিযোগ আছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে। সেক্ষেত্রে আমাদের মনে হয় যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা হয়েছে।”
তিনি আরো বলেছিলেন, “আমাদের অধিনায়ক যারা আছে তাদের কড়া নির্দেশ দেয়া আছে, যাতে করে নিরপরাধ কেউ যেন কখনো ভিকটিমাইজ না হয়।এবং আমরা সব সময় সেটা নিশ্চিত করি”।
মি. খান বলেন “যখন গোলাগুলি হয় তখন প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করা হয়। এই অভিযান কোন সুনির্দিষ্ট সময় লক্ষ্য করে করা হয় নি।”
“এটা একটা বিশেষ অভিযান। অবশ্যই পরিস্থিতির বিবেচনায় এর ধরণ প্রকৃতির পরিবর্তন আসবে। পরিস্থিতি আসলে বলে দেবে এই অভিযান কত দিন চলবে। অভিযান যেটা শুরু হয়েছে সেটা চলমান থাকবে।”
মাদকবিরোধী মামলাগুলো কী নিস্পত্তি হয়?
বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মাদক আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে মোট ১১,৬১২টি।
চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৩২৮৯টি।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ বলছেন, “২০১৭ সালে ২৫৪৪টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১০১৬টি মামলায় আসামীর সাজা হয়েছে। আর আসামী খালাস পেয়েছে ১৫২৮টি মামলায়”।
বাংলাদেশের মাদক বিরোধী আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা থাকলেও এর কিছু ত্রুটি এখনো রয়ে গেছে।
এ সম্পর্কে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো.জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, “প্রচলিত আইনের তফসিলে বেশ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত নেই। যাদের মাদকের গডফাদার বা মাস্টার-মাইন্ড বলা হয় তাদেরকে আইনে সোপর্দ করার কোন ব্যবস্থা বর্তমান আইনে নেই।”
“আমরা আইন সংশোধন করে, যারা মাদকের ব্যবসা করে এবং মাদক তৈরি করে তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য আইনানুগ বিধান তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছি,” বলে মন্তব্য করেন মি. আহমেদ।
সূত্র, বিবিসি